ফিতনা কালীন যুগে ইরাকের কুফা নগরী সম্পর্কে অনেকগুলো হাদীস রয়েছে। আর এই শহরটি কিয়ামতের আলামত সংক্রান্ত যুদ্ধ বা, ধ্বংস হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। তাই হাদীসে বর্নিত কুফা নগরী বলতে, কোন শহরকে বুঝানো হয়েছে? তা আমাদের জানা দরকার। আর কুফা নগরী সম্পর্কিত সব হাদিসগুলো মূলত তিনটি মূল ঘটনাকে কেন্দ্র করে বর্নিত। যেমনঃ
১,কুফা নগরীতে প্রসিদ্ধ ১২ টি ঝান্ডাবাহী পতাকা উত্তোলন করা হবে। (২০১৬-২০১৭)
২, সুফিয়ানী কুফা নগরীতে কালো পতাকাবাহী আসবাব জাতির(Islamic state) ৭০ হাজার সৈন্যকে হত্যা করবে।
৩,রোমানরা (খ্রিস্টানরা) ও মুসলিমরা মিলে কুফা নগরীকে ধ্বংস করে ফেলবে।
হাদিসে বর্ণিত কুফা নগরী কোনটি?
________________________________
মূলত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবীদের যুগে ইরাক ও কুয়েত নামে কোন ভূখণ্ড ছিল না, বর্তমান ইরাক ও কুয়েতকে বসরা ও কুফা নামে ডাকা হত। অর্থাৎ যদি কুফা ও বসরা উল্লেখ করে কোন হাদিস বর্ননা করা হত, তখন বুঝা যেত, এটা বৃহত্তর ইরাক ও কুয়েত কেই বুঝানো হয়েছে? আর বাগদাদ নগরীকে ডাকা হত জাওরা নামে। চলুন হাদিস থেকেই জানি, ইরাকের কুফা নগরী বলতে বর্তমান কুফা নগরীকে বুঝানো হয়েছে? নাকি অন্য কোন শহরকে বুঝানো হয়েছে?
** হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্নিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যখন সুফইয়ানী ফোরাত নদী পার হবে এবং এমন এক জায়গায় পৌছবে যার নাম হবে আকের কুফা (ইরাক ও সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকা)। আল্লাহ তা’আলা তার অন্তর থেকে ঈমানকে মুছে দিবেন। আর সেখানে একটি নদীর দিকে যে নদীর নাম হবে দাজীল (দাজলা নদী/Tigress River) । উক্ত নদীর নির্জন প্রান্তরে ৭০ হাজার তরবারীধারী(যোদ্ধা) লোককে সে হত্যা করবে। তখন তাদের ব্যতীত তাদের থেকে বেশী লোক থাকবে না। অতপর স্বর্ণের ঘরের (পাহাড়) উপর প্রকাশ পাবে। অতপর তারা যুদ্ধ করবে এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে। অতপর তারা মহিলাদের পেট চিড়বে বা ফাড়বে। তারা বলবে হয়তো সে কোন গোলাম ( Islamic state) কর্তৃক গর্ভবতী হয়েছে। আর দাজলার পাড়ে র্মারা এর দিকে মহিলাগণ কুরাইশদের নিকট সাহায্য কামনা করবে। সুফুনের (মসূল ও কিরকুক শহরের মধ্যবর্তী জায়গা) অধিবাসীদেরকে তারা ডাকবে যাতে তাদেরকে উঠিয়ে নেয় এবং যাতে তারা তাদেরকে মানুষের সাথে সাক্ষাত করাতে পারে। আর তারা বনু হাশেমের উপর শত্রুতার কারণে তাদেরকে উঠাবে না। আর তোমরা বনু হাশেমের সাথে শত্রুতা পোষণ করিও না, কেননা তাদের থেকেই রহমতের নবী (সাঃ) আর তাদের থেকে জান্নাতে পাখি হবে।
হে মহিলাগন! তখন কি অবস্থা হবে যখন জাহান্নামের অন্ধকার গর্তসমূহে তোমাদেরকে নিক্ষেপ করবে যে গর্তগুলো থাকবে ফাসেকদের জন্য বরাদ্দ থাকবে। অতপর তাদের নিকট সাহায্য (খোরাসানের বাহিনী) আসবে। এমনকি তারা (খোরাসানের বাহিনী) সুফইয়ানীর সাথে যে সমস্ত মহিলা ও সন্তান সন্ততি আটক থাকবে তাদেরকে বাগদাদ ও কুফা থেকে উদ্ধার করবে।
[ আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ - ৮৮৫ ]
এই হাদিসটিতে হাদীসে বর্নিত কুফা নগরীর তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে সুফিয়ানী গনহত্যা চালাবে।
A) শহরটি হবে দাজলা বা, Tigress নদীর তীরে। মসূল শহর কিন্তু দাজলা নদীর তীরে অবস্থিত সবচেয়ে বড় শহর। অথচ, ইরাকের বর্তমান কুফা নগরী হল ফোরাত নদীর তীরে।
B) সুফিয়ানী গনহত্যা সংগঠিত করার পর, সেখানে ধ্বংসস্তুপে আটকা পরা মহিলারা পার্শ্ববর্তী সুফূনের (মসূল ও কিরকুক শহরের মধ্যবর্তী জায়গা) লোকদেরকে উদ্ধার করার জন্য ডাকবে। সুফূন থেকে বর্তমান কুফা নগরীর প্রায় ৪০০ কিঃমিঃ। আর সুফূন থেকে মসূল শহরের দূরত্ব ১০০ কিঃমিঃ এর মত। তাই ৪০০ কিঃমিঃ দূরের লোকদেরকে উদ্ধারের জন্য ডাকবে এটা যৌক্তিক নয়।
C) সুফূনের অধিবাসীরা কালো পতাকাবাহী (Islamic state) এর ধ্বংসস্তুপে আটকা পরা মহিলাদের শত্রুতা বশতঃ উদ্ধার করবে না। সুফূন একটি গ্রামের নাম এর নিকটবর্তী বড় শহর হল কিরকুক। যার ৬০% মানুষ হল শিয়া মুসলিম। আর শিয়াদের সাথে Islamic state এর সাথে জন্ম থেকেই দা-কুমড়া সম্পর্ক।
তাই হাদীসে বর্নিত কুফা নগরী বলতে মসূল শহরকেই বুঝানো হয়েছে। যার আরো একটি প্রমাণ হলঃ
১,কুফা(মসূল) শহরে ১২ টি ঝান্ডাবাহী পতাকা উত্তোলন করা হবেঃ
_____________________________________________
** হযরত আবু জাফর (রহঃ) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন, যখন (কালো পতাকাবাহী দলের) তাদের বক্তব্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হবে এবং যুসশিফার আত্নপ্রকাশ হবে। তখন তোমাদের আর বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হবেনা, এক পর্যায়ে মিশরে আবকা জাতির(Tuareg) আবির্ভাব ঘটবে। তারা লোকজনকে হত্যা করতে করতে আরম(Damascus) পর্যন্ত পৌছিয়ে দিবে। অতঃপর মাশু গোত্র তাদের উপর হামলা করে বসবে এবং উভয়ের মধ্যে মারাত্নক একটা যুদ্ধ সংঘঠিত হবে। এরপর সুফিয়ানী মালউন প্রকাশ পাবে এবং উভয়ে জয়লাভ করবে। এর পূর্বে অবশ্যই কুফা নগরীতে প্রসিদ্ধ বারোটি ঝান্ডার প্রদর্শনী হবে। ইতোমধ্যে হোসাইন (রাঃ) এর বংশ ধরদের একদল কুফাতে আগমন করে মানুষকে তার পিতার দিকে আহবান করবে। এরপর সুফিয়ানী তার সৈন্যদেরকে সংবাদ সরবরাহ করবে।
[ আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ - ৮৩৬ ]
এই হাদিসটিতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে? যেমনঃ
١) যুশ শিফার আত্নপ্রকাশ করবে। প্রশ্ন হল, যুশ শিফার কি?
যুশ শিফার এর শাব্দিক অর্থ আমার জানা নেই, তবে আমার ধারণা মতে, এর অর্থ সংশোধনকারী, পরিবর্তনকারী। কারন, সম্পূর্ণ একটা জাহেলী সমাজে খিলাফত ঘোষণা করা, ইসলামী শরিয়া আইন সম্পূর্ণ রুপে বাস্তবায়ন করা সহজ কাজ নয়। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এর উপর তাদের একটা নাশিদ শুনছিলাম, যার এর মিল রয়েছে। লিংকঃ https://archive.org/details/IslamicStateNasheedMediaArchive#
٢) কুফা(মসূল) নগরীতে ১২ টি ঝান্ডার প্রদর্শনী হবে?
আপনি জানেন কি? ২০১৬ সালে ঈসলামিক ইস্টেট এর থেকে মসূল উদ্ধার করার জন্য, তাদের বিরুদ্ধে কতটি পতাকা একত্রিত হয়েছিল। উত্তর হল, ১২ টি। যেমনঃ
১,ইরাকী সরকার।
২, ইরাকী কুর্দি বাহিনী।
৩,যুক্তরাষ্ট্র।
৪,যুক্তরাজ্য।
৫,কানাডা।
৬,অস্ট্রেলিয়া।
৭,তুরস্ক।
৮,ফ্রান্স।
৯, জার্মানি।
১০, ইরান।
১১,লেবাননের হিজবুল্লাহ ।
১২, Army of the men of nakshabandi group (সুফি পন্থী নকশাবন্দি দল)
(রেফারেন্সঃhttps://en.m.wikipedia.org/wiki/Battle_of_Mosul_%282016%E2%80%932017%29
এই যুদ্ধে ইসলামিক ইস্টেট এর ৬০০০ যোদ্ধাদের বিপরীতে ১২ টি সম্মিলিত কুফুরি শক্তির যোদ্ধা ছিল ১,১৪,০০০। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইরাক ও তুরস্কের সম্মিলিত বিমান হামলা তো রয়েছেই।তারা প্রায় ২০ হাজার বারের বেশি হামলা চালিয়েছে। তাদের বিমান হামলায় পশ্চিম মসূলের বেশিরভাগ ভবন ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়েছিল। তার পরেও মাত্র ৬ হাজার ইসলামিক ইস্টেট এর যোদ্ধাদের থেকে মসূল শহর উদ্ধার করতে তাদের সময় লেগে যায় ৯ মাস। ইরাকী ও কুর্দি বাহিনীর ২১,০০০ যোদ্ধা নিহত হয়।তবে কুর্দি গোয়েন্দা বিভাগের তথ্য মতে, এই যুদ্ধে সাধারণ মানুষ সহ মোট নিহত হয়েছে ৪০ হাজার মানুষ। গৃহহীন হয়েছে ১০ লক্ষ লোক। আহত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ। এই যুদ্ধে ইসলামিক ইস্টেট প্রায় ৪০০ আত্মঘাতী/ইশতিশাদি হামলা চালায়, যা আধুনিক ইতিহাসে বিরল। এই যুদ্ধে ইরাকী ও কুর্দি বাহিনীর প্রায় ৫০% যুদ্ধযান, ট্যাংক, হামাবী, গাড়ি, ও অন্যান্য অস্ত্র ধ্বংস হয়ে গেছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন বাহিনীর বিমান হামলায় ৮৪২ বছরের পুরনো আন নুরি গ্রেন্ড জামে মসজিদ সহ অসংখ্য মসজিদ ধ্বংস হয়ে গেছে। ইতোমধ্যেই এই যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে, অনেক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলামিক ইস্টেট যদি দ্বিতীয়বার পুনরায় মসূল শহর আক্রমণ করে, তাহলে সেটা প্রতিহত করার সামর্থ্য ইরাকী বাহিনীর নেই। লিংকঃhttp://www.independent.co.uk/news/world/middle-east/mosul-massacre-battle-isis-iraq-city-civilian-casualties-killed-deaths-fighting-forces-islamic-state-a7848781.html
এছাড়াও মসূল যুদ্ধ নিয়ে Al Jazeera এর প্রতিবেদনটি দেখতে পারেন। লিংকঃ https://youtu.be/oJPQUfRndxE
٣) হযরত হোসাইন (রাঃ) বংশধর দের একদল কুফাতে(মসূল) আসবে?
ইসলামিক ইস্টেট এর খলিফা আবু বকর আল বাগদাদী (হাফিঃ) হলেন, কুরাইশ বংশের হযরত হোসাইন (রাঃ) এর বংশধর। তার পুরো নাম হল, আবু বকর আল বাগদাদী আল হোসাইনী আল হাশেমী আল কুরাইশী। তার উপাধি ছিল আবু দুয়া। তার জন্মগত নাম ছিল, ইব্রাহিম আওয়াদ ইব্রাহিম আল বদরী।
২,সুফিয়ানী কুফা(মসূল) নগরীতে কালো পতাকাবাহী আসহাব জাতির(Islamic state) ৭০ হাজার সৈন্যকে হত্যা করবেঃ
_____________________________________________
** হযরত আরতাত (রাঃ) বলেন,“সুফিয়ানি কুফায় (মসূল শহরে) প্রবেশ করবে। ৩ দিন পর্যন্ত সে দুশমনদের(Islamic state) বন্দীদেরকে সেখানে আটকে রাখবে এবং ৭০ হাজার কুফাবাসীকে(মসূল বাসী) হত্যা করে ফেলবে। তারপর সে ১৮ দিন পর্যন্ত আঠার দিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে তাদের (Islamic state) সম্পদগুলো বণ্টন করবে। তখন তাদের মধ্যে একদল খোরাসানে ফেরত যাবে। সুফিয়ানির সৈন্যবাহিনী আসবে এবং কুফার(মসূল) বিল্ডিংগুলো ধ্বংস করে সে খোরাসানবাসীদেরকে তালাশ করবে। খোরাসানে একটি দলের আবির্ভাব ঘটবে, যারা ইমাম মাহদির দিকে আহ্বান করবে। অতঃপর মাহদি ও মানসুর (একজন সেনাপতি) উভয়ে কুফা(মসূল) থেকে পলায়ন করবে। সুফিয়ানি উভয়ের তালাশে সৈন্য প্রেরণ করবে। অতঃপর যখন মাহদি ও মানসুর মক্কায় পৌঁছে যাবে, তখন সুফিয়ানির বাহিনীকে ‘বায়দা’ নামক স্থানে মাটির নিচে ধ্বসিয়ে দেওয়া হবে। এরপর মাহদি মক্কা থেকে বের হয়ে মদিনায় যাবেন এবং ওখানে বনু হাশেমকে মুক্ত করবেন। এমন সময় কালো পতাকাবাহী লোকেরা এসে পানির(সমুদ্রে) উপর অবস্থান করবে। কুফায়(মসূল) অবস্থিত সুফিয়ানির লোকেরা কালো পতাকাবাহী দলের আগমনের কথা শুনে পলায়ন করবে। কুফার (মসূল) এর সম্মানিত লোকেরা বের হবে যাদেরকে ‘আসহাব’ বলা হয়ে থাকে, তাদের কাছে কিছু অস্ত্র শস্ত্রও থাকবে এবং তাদের মধ্যে বসরা’বাসীদের থেকে একজন লোক থাকবে। অতঃপর কুফা বাসী (মসূল শহরের লোকজন) সুফিয়ানির লোকদেরকে ধরে ফেলবে এবং কুফার যে সব লোক তাদের হাতে থাকবে, তাদেরকে মুক্ত করবে। পরিশেষে কালো পতাকাবাহী দল এসে মাহদির হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবে”।
(আল ফিতানঃ ৮৫০, মুহাক্কিক আহমদ ইবনে সুয়াইব এই হাদিসটির সনদকে ‘লাবাসা বিহা’ বা ‘বর্ণনাটি গ্রহণ করা যেতে পারে’ বলেছেন)
৩,মুসলমানরা ও খ্রিস্টানরা মিলে কুফা (মসূল) নগরী ধ্বংস করে দিবেঃ
_____________________________________________
এছাড়াও মুসলমানদের সাথে খ্রিস্টানদের মহাযুদ্ধের পূর্বে এই শহরকেই মুসলমান ও খ্রিস্টানরা মিলে ধ্বংস করে দিবে। তখন সম্ভবত শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন এই শহরটিকে দখলে রাখবে।
** হযরত কা’ব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তোমরা ও খ্রিস্টানরা একটি শান্তিচুক্তি (১০ বছরের জন্য) করবে। তারপর তোমরা এবং খ্রিস্টানরা মিলে কুফা (মসূল) নগরীতে হামলা করবে। আর এটাই হবে কুফা নগরী সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংসের কারন"। (আল ফিতানঃ নুয়াইম বিন হাম্মাদ)
তাই আমাদেরকে হাদীসের বর্নিত কুফা নগরী সম্পর্কিত সকল হাদিসগুলো সতর্কতার সাথে মসূল শহরের সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে।
Social Plugin