রমজানের আগের মাস শাবান। শাবান রমজানের আগাম বার্তা বয়ে আনে। শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত অনেক তাৎপর্যবহ ও গুরুত্বপূর্ণ। এ রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। ‘শবে বরাত’ ফার্সি ভাষার দুইটি শব্দ। ফার্সিতে ‘শব’ মানে রাত আর ‘বরাত’ মানে মুক্তি। সুতরাং ‘শবে বরা’ এর অর্থ হলো মুক্তির রাত। শবে বরাতকে কোরআনে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ বলা হয়েছে। হাদিসে বলা হয়েছে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা মধ্য শাবানের রাত।

হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ, তাফসিরের কিতাব, ও ফিকহের গ্রন্থগুলোতে ভিন্ন নামে, ভিন্ন শব্দে ও ভিন্ন পরিভাষায় শবে বরাতের আলোচনা এসেছে। যেমন- ‘লাইলাতুল কিসমাহ’ বা ভাগ্যরজনী, ‘লাইলাতুল আফউ’ বা ক্ষমার রাত, ‘লাইলাতুত তাওবাহ’ বা তাওবার রাত, ‘লাইলাতুল ইৎক’ তথা জাহান্নাম থেকে মুক্তির রাত, ‘লাইলাতুত দোয়া’ বা প্রার্থনার রাত।

শবে বরাতের ফজিলত, সওয়াব ও কল্যাণ সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মধ্য শাবানের রাতে—অর্থাৎ শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষী লোক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং : ৫৬৬৫, শুআবুল ঈমান, হাদিস নং : ৬৬২৮)

শবে বরাত অনেক ফজিলত ও বরকতপূর্ণ। কিন্তু কিছু লোক এ রাতের ফজিলত ও বরকত থেকে বঞ্চিত থাকে। এ পবিত্র রাতে কয়েক শ্রেণির লোকের জন্য দয়া ও ক্ষমার দরজা বন্ধ থাকে। এক. মুশরিক (যে আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করে)। দুই. হিংসা-বিদ্বেষপোষণকারী। তিন. ডাকাত। চার. মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান। পাঁচ. অন্যায়ভাবে হত্যাকারী। ছয়. জিনা-ব্যভিচারকারী। সাত. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী। আট. টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী। নয়. মদপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি। (শুআবুল ঈমান, হাদিস নং : ৩৫৪৪)

শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস শরিফে এসেছে, ‘এমন পাঁচটি রাত রয়েছে, যেগুলোতে আল্লাহ তাআলা বান্দার দোয়া ফিরিয়ে দেন না। সে রাতগুলো হলো, জুমার রাত, রজবের প্রথম রাত, শাবানের ১৫ তারিখের রাত, দুই ঈদের রাত।’ (সুনানে বায়হাকি, হাদিস নং : ৬০৮৭, শুআবুল ঈমান, হাদিস নং : ৩৪৪০, মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস নং : ৭৯২৭)

প্রখ্যাত মুসলিম মনীষী ও বিচারপতি আল্লামা তকি উসমানি লিখেছেন, ‘শবেবরাতের ফজিলত দশ জন সাহাবি থেকে বর্ণিত হয়েছে। এর মাধ্যমে এ রাতের বিশেষ গুরুত্ব প্রমাণিত হয়। এ বিষয়ে কয়েকটি হাদিস বর্ণনা সূত্রের দিক থেকে সামান্য দুর্বল। এসব সনদ বা সূত্র দেখে কেউ কেউ বলে দিয়েছেন, এ রাতের ফজিলতের কোনো ভিত্তি নেই! অথচ মুহাদ্দিস ও ফকিহদের সিদ্ধান্ত হলো, কোনো বর্ণনার সূত্র দুর্বল হলে এর সমর্থক হাদিস থাকলে তার দুর্বলতা কেটে যায়। তবে স্মরণ রাখতে হবে যে শবেবরাতের স্বতন্ত্র কোনো ইবাদত নেই আর এ রাতের জন্য ইবাদতের আলাদা কোনো নিয়মও নেই।’ (মাসিক আল-বালাগ, শাবান, ১৪৩১ হিজরি)

শবে বরাতে কবর জিয়ারত
আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, “রাসুল (সা.) মধ্য শাবানের রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’-তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করতেন।” তিনি বলেন, ‘এ রাতে মহান আল্লাহ বনি কালবের বকরির পশমের সংখ্যার চেয়েও বেশিসংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।’ (তিরমিজি, হাদিস নং: ৭৩৯, ইবনে মাজাহ, হাদিস নং : ১৩৭৯)

শবে বরাতে রোজা
একটি হাদিসে ১৫ শাবান বা শবে বরাতে রোজা রাখার নির্দেশনা রয়েছে। আলী (রা.) সূত্রে বর্ণিত সে হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘১৫ শাবানের রাত যখন হয়, তোমরা রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে পালন করো এবং দিনের বেলা রোজা রাখো। কেননা এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ প্রথম আসমানে এসে বলেন, ‘কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিক অন্বেষণকারী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দেব। আছে কি কোনো রোগাক্রান্ত? আমি তাকে আরোগ্য দান করব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে তাদের ডাকতে থাকেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং : ১৩৮৮)

শবে বরাতে নির্দিষ্ট কোনো ইবাদত নেই
শবে বরাতের নির্দিষ্ট কোনো ইবাদত-বন্দেগি ও আমল-আজকার নেই। তবে এ আমলগুলো করা যায়—এশা ও ফজর নামাজ ওয়াক্তমতো জামাতের সঙ্গে আদায় করা, যথাসম্ভব নফল ও তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা, সম্ভব হলে অতীত জীবনের কাজা নামাজ ও সালাতুত তাসবিহ আদায় করা। পবিত্র কোরআন বেশি বেশি তিলাওয়াত করা, বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করা, বেশি করে দোয়া করা, মাঝে মাঝে শবেবরাতে কবর জিয়ারত করা, পরের দিন রোজা রাখা। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হাফেজ ইবনে রজব (রহ.) বলেন, ‘এ রাতে জিকির ও দোয়ার জন্য পুরোপুরি অবসর হবে। প্রথমে খাঁটি মনে তাওবা করবে। এরপর মাগফিরাত ও ক্ষমা প্রার্থনা করবে। আপদ-বিপদ দূর হওয়ার জন্য দোয়া করবে ও নফল নামাজ পড়বে।’ (লাতায়িফুল মাআরিফ : ১/১৩৮)

রাত জেগে বা শেষ রাতে ইবাদত
সারা রাত জেগে ইবাদত করা অনেকে পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। তারা যদ্দুর সম্ভব ইবাদত-বন্দেগি করে করে ঘুমিয়ে যাওয়া ভালো। আর সুযোগ হলে শেষ রাতের সময়টুকু ইবাদতে কাটানো চাই। শেষ রাতের ইবাদতে মগ্ন হওয়া ও আত্মনিবেশ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে খেয়াল রাখা চাই, রাতের নফল ইবাদতের কারণে যেন ফজরের ফরজ নামাজ ছুটে না যায়।

শবে বরাতে একাকী ইবাদতই উত্তম
বিশুদ্ধ মতানুসারে শবেবরাত ও শবেকদরের নফল আমলগুলো একাকী করণীয়। ফরজ নামাজ অবশ্যই মসজিদে জামাতের সঙ্গে আদায় করতে হবে। এরপর যা কিছু নফল পড়ার, তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বে। বিভিন্ন হাদিস থেকে এ রাতে দীর্ঘ নামাজ পড়া, সিজদা দীর্ঘ হওয়া, দোয়া-ইস্তেগফার করার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। (শুআবুল ঈমান, বায়হাকি : ৩/৩৮২, ৩৮৩)

মহান আল্লাহ আমাদের সঠিকভাবে আমল করার এবং ভুল-ত্রুটি ও কুসংস্কার থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।